সাকিব আহসান
প্রতিনিধি,পীরগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও
আঁকাবাঁকা মেঠোপথ, পীরগঞ্জ শহর থেকে প্রায় পাঁচ কিলো দূরে অবস্থিত একটি বাজার। নাম তার আনন্দবাজার।
একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শহুরে সভ্যতার নিদর্শন হিসেবে সেখানে রয়েছে। বাদবাকি সবই 'কালের ধুলোয় ' জমা স্মৃতিজড়িত প্রাণ,জীবন এবং যাপন।
আনন্দ বাজারের মাথার উপর একটি 'ছাতা' রয়েছে। দু'শ বছর পুরোনো বটগাছের ছায়া। এই ছায়াকে কেন্দ্র করে এখানকার লোকালয় গড়ে উঠেছে। বটগাছের সাথে তর্ক করে একটি ছাতিম গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে গেছে। বট,ছাতিমের ছায়াতলে ঢুকলে পৌরাণিক অস্তিত্বের ছোঁয়া পাওয়া যায়। ঘাটতে ঘাটতে বেরিয়ে এলো বটবৃক্ষের ছায়ায় মায়া ধরে রাখা পৌরাণিক ঘটনার প্রতিচ্ছবি। জনশ্রুতি থেকে জানা যায় স্থানটি জগন্নাথ ঠাকুরের অবতারের চিহ্ন।
ওই এলাকার দর্শন চন্দ্র রায় জগন্নাথ ঠাকুর সম্পর্কে বলেন," জগন্নাথদেবকে কেন্দ্র করে দুটি জনপ্রিয় কাহিনি প্রচলিত আছে। প্রথম কাহিনি অনুসারে, কৃষ্ণ তার ভক্ত রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের সম্মুখে আবিভূর্ত হয়ে পুরীর সমুদ্রতটে ভেসে আসা একটি কাষ্ঠখণ্ড দিয়ে তার মূর্তি নির্মাণের আদেশ দেন। মূর্তিনির্মাণের জন্য রাজা একজন উপযুক্ত কাষ্ঠশিল্পীর সন্ধান করতে থাকেন। তখন এক রহস্যময় বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ কাষ্ঠশিল্পী তার সম্মুখে উপস্থিত হন এবং মূর্তি নির্মাণের জন্য কয়েকদিন চেয়ে নেন। সেই কাষ্ঠশিল্পী রাজাকে জানিয়ে দেন মূর্তি নির্মাণকালে কেউ যেন তার কাজে বাধা না দেন। বন্ধ দরজার আড়ালে শুরু হয় কাজ। রাজা ও রানি সহ সকলেই নির্মাণকাজের ব্যাপারে অত্যন্ত আগ্রহী হয়ে ওঠেন। প্রতিদিন তারা বন্ধ দরজার কাছে যেতেন এবং শুনতে পেতেন ভিতর থেকে খোদাইয়ের আওয়াজ ভেসে আসছে। ৬-৭ দিন বাদে যখন রাজা বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন এমন সময় আওয়াজ বন্ধ হয়ে যায়। অত্যুৎসাহী রানি কৌতূহল সংবরণ করতে না পেরে দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করেন। দেখেন মূর্তি তখনও অর্ধসমাপ্ত এবং কাষ্ঠশিল্পী অন্তর্ধিত। এই রহস্যময় কাষ্ঠশিল্পী ছিলেন দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা। মূর্তির হস্তপদ নির্মিত হয়নি বলে রাজা বিমর্ষ হয়ে পড়েন। কাজে বাধাদানের জন্য অনুতাপ করতে থাকেন। তখন দেবর্ষি নারদ তার সম্মুখে আবির্ভূত হন। নারদ রাজাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন এই অর্ধসমাপ্ত মূর্তি পরমেশ্বরের এক স্বীকৃত স্বরূপ।"
অপরদিকে তপন চন্দ্র রায়ের কাছে জানতে চাইলে তিনি নিত্যানন্দ ঠাকুরের প্রসঙ্গ টেনে বলেন,"
নিত্যানন্দ প্রভু খড়দহে দুর্গাপূজা শুরু করেন। তিনি কাত্যায়নী রূপে মা দুর্গার আরাধনা করেন। তাঁর অনেক বংশধরের বাড়িতে আগে এই পূজা হত। এখনও বড়বাড়ি এবং মেজোবাড়িতে এই পূজা হয়। এই পূজা শুরু হয় উলটো রথের দিন। এখানে মা দুর্গার দু পাশে জয়া, বিজয়া থাকে। দেবীর বাহন সিংহের মুখ ঘোড়ার মত।এখানে চালকুমড়ো বলি দেওয়া হয়। নিত্যানন্দ প্রভুর ১৪তম বংশধর সরোজেন্দ্রমোহন গোস্বামী আজও এই পূজা করে চলেছেন। কথা চলতে চলতে ৮ নং ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য সরকিত চন্দ্র রায় যোগ দিয়ে বলেন বুড়িঠাকুরের কথা। তাঁর ভাষ্যমতে বুড়িঠাকুর অনাবৃষ্টিজনিত দুর্ভিক্ষে জীবজগৎ অসহায়ত্ব দেখে মুনিরা হিমালয়ে গিয়ে দেবী দুর্গার শরণাপন্ন হলেন। দেবী অপূর্ব দেহকান্তি নিয়ে আবির্ভূতা হলেন। দেবীর চার হাতে বান, পদ্ম, ক্ষুধাতৃষ্ণা জরা নাশক পুষ্প, পল্লব, ফলমূল, শাক, এক মহাধনু। করুণার্দ্র হৃদয়া দেবীর নয়ন থেকে অবিরত অশ্রু বিসর্জনে নয় দিন ধরে নির্জলা পৃথিবীতে খুব বৃষ্টি শুরু হলো। তাতে ভরে গেল নদ-নদী। তৃপ্ত হলো গাছপালা, মানুষ, সব প্রাণিজগৎ। যতদিন না আবার নতুন ফসল উঠল, ততদিন দেবী নিজের হাতের শাক, ফল ইত্যাদি দিয়ে মানুষ, গবাদি পশুর প্রাণ রক্ষা করলেন।
এভাবেই পীরগঞ্জের আনন্দবাজারে এক চায়ের আড্ডায় পৌরাণিক কাহিনীর কল্পনাজগতে পদধূলি দেওয়া হল।
সরোয়ার হোসেন কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত